রহস্য।
-------------------------------------------------------------
সৃষ্ট সকল বস্তুর আসল সুরত গোলাকৃতির,*
সেই বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুটিই হয় অভীষ্ট মকসুদ।*
প্রভুর পবিত্র একক সত্তা মহাপবিত্র।
অবিনশ্বর সেই সত্তা অতুলনীয়, উনার অজুদ (অস্তিত্ব) উনার যাতের (সত্তার) অনুরূপ বাসিতে হাকীকী (প্রকৃত অবিমিশ্র); আর, তা বিন্দুর মতই (বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুর ন্যায়)*; (তন্মধ্যে কোনরূপ ভাগ-বন্টন হয় না। কিন্তু, অসংখ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে তা বিস্তৃত এবং প্রশস্ত বলে মনে হয়।)
*হৃদয় দর্পণে পতিত আলোক ও এর প্রতিফলনে*,
*আয়নাটির পারা রূপে বিরাজমান স্রষ্টার ধ্রুবসত্য তাওহীদ।*
আল্লাহ্ তা'আলা নিরাকার;
- আনিছুত্তালেবীন। (৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৫৬)
(ছিফাতে ছালবিয়াঃ
আল্লাহ্ তা'আলা স্থানে ও কালে আবদ্ধ নন, কোন বস্তুতে মিলিত নন, কোন দিকে নন, উনার তুল্য কোন বস্তু নেই।)
- আনিছুত্তালেবীন। (৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬৪)
মুশাহিদাঃ মাশায়েখগণ বলেছেন, বেলায়েতের দরজায় পৌঁছানোর পর আহলুল্লাহদের দর্শন নফসের মধ্যে হয়ে থাকে। স্বীয় নফসের বাইরের দর্শন, যা 'সায়ের ইলাল্লাহ্' বা, আল্লাহর দিকে সায়েরের সময় পথিমধ্যে প্রকাশিত হয়, সে অবস্থা ধর্তব্য নয়। এই দরবেশের উপর যা প্রকাশিত হয়েছে, তা হচ্ছেঃ স্বীয় নফসের মুশাহিদা বা, দর্শন, নফসের বাইরের মুশাহিদার ন্যায় বিশ্বাসযোগ্য নয়, এই জন্য যে, উক্ত মুশাহিদা, প্রকৃতপক্ষে হক সুবহানুহুর মুশাহিদা নয়। কেননা, হক সুবহানুহু তাআ'লা যখন তুলনাহীন এবং রূপ ও বর্ণনাহীন, তখন তিনি কীরূপে তুলনারূপ দর্পণে সীমিত হতে পারেন? যদিও উক্ত দর্পণ নফসের মধ্যে অথবা, বাইরে থাকে। হক সুবহানুহু তা'আলা না দুনিয়ার মধ্যে এবং না তার বাইরে; না দুনিয়ার সঙ্গে মিলিত এবং না দুনিয়া থেকে আলাদা। আল্লাহ্ তা'আলার দর্শন, না এই দুনিয়ার মধ্যে সম্ভব এবং না এর বাইরে। আর, ঐ দর্শন, না দুনিয়ার সঙ্গে মিলিত এবং না দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। এই জন্য ঐ দর্শন, যা আখেরাতে হবে; জ্ঞানীগণ সে সম্পর্কে বলেছেন যে, ঐ দর্শন বেলা কায়েফ বা, প্রকারহীন হবে; যা জ্ঞানবুদ্ধির সীমার বাইরে। আল্লাহ্ তা'আলা এই গোপন রহস্যকে তাঁর একান্ত প্রিয় বান্দাদের নিকট এই দুনিয়াতে প্রকাশ করেছেন। যদিও তা দর্শন নয়, তথাপিও তা দর্শনের অনুরূপ। এটা সেই মহাসম্পদ, যা সাহাবায়ে কেরামদের (রিদওয়ানুল্লাহু তা'আলা 'আলাইহিম আজমাঈন) যামানার পর খুব অল্পসংখ্যক লোকেরই নসীব হয়েছে। আজও অনেকে একথা অবাস্তব বলে ধারণা করে এবং অধিকাংশ লোকই একথা গ্রহণ করবে না; তবুও এই ফকীর একথা প্রকাশ করছে। চাই অপরিণামদর্শী লোকেরা একথা কবুল করুক, আর নাই-ই করুক। এই পবিত্র নেসবতটি, এই বিশেষত্বের সাথে, আগামীতে হজরত মাহদী ('আলাইহি রিদওয়ানের) সময় প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহু তা'আলা। যারা হেদায়েতের অনুসারী এবং মোস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ প্রতিপালনকারী, তাদের প্রতি সালাম এবং তাঁর (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিবার পরিজন ও সাহাবীদের উপর সালাম ও রহমত নাযিল হোক ।
-মাবদা ওয়া মা'আদ, পৃষ্ঠা ২৩।
(লেখকঃ শায়খ আহমাদ ফারুক সিরহিন্দ মুজাদ্দেদে আলফে সানী রাহমাতুল্লাহি 'আলাইহি।)
নফীয়ে কুলঃ তালেবের জন্য এটা জরুরী যে, সে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত প্রকার বাতিল মা'বুদসমূহকে নফী বা, ধ্বংস করবে এবং প্রকৃত মা'বুদের স্থিতির জন্য তার স্মৃতিপটে যা কিছু উদয় হয়, সে সমস্তকেও বিদূরিত করে কেবলমাত্র হক তাআ'লার মওজুদ থাকাকে যথেষ্ট মনে করবে। এই মাকামে অজুদ বা, অস্তিত্বের কোনো সম্ভাবনাই নেই, কাজেই হক তায়া'লার যাতকে অজুদ ব্যতীতই তালাশ করা দরকার।
আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআ'তের আলেমগণ কী সুন্দরই না বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা'আলার অজুদ, তাঁর 'যাত' সুবহানুহু ওয়া তা'আলার উপর অতিরিক্ত। অজুদকে প্রকৃত যাত বলা এবং অজুদের উপর অন্য কোনো বিষয় স্থির না করা, দৃষ্টির সংকীর্ণতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। শায়েখ আলাউদ্দৌলা (রাহমাতুল্লাহি 'আলাইহি) বলেছেন, হক জাল্লা শানুহুর দুনিয়া অস্তিত্বের জগতেরও উর্ধ্বে; এই ফকীরকে যখন অস্তিত্বের জগতের উপর নেয়া হয়, তখন হালের আধিক্যের মধ্যে থাকাবস্থায়ও আমি নিজেকে অনুসরণ জ্ঞানের দ্বারা মুসলিম হিসাবে গণ্য করতে থাকি। মোদ্দাকথা, সম্ভাব্যের ধারণায় যা কিছু আসে, তা সম্ভাবনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। সুতরাং, অতি পবিত্র ঐ যাত, যিনি মাখলুকের জন্য- স্বকীয় পরিচিতি প্রদানের লক্ষ্যে অক্ষমতা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি।
- মাবদা ওয়া মা'আদ, পৃষ্ঠা ২৭।
*তথ্যসূত্রঃ
*
*মাআরিফে লাদুন্নিয়া, পৃষ্ঠা-১৮; লেখকঃ শাইখ আহমাদ ফারুক সিরহিন্দ মুজাদ্দেদে আলফে সানী। (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)
*আনিছুত্তালেবীন- ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২০০; লেখকঃ হাফিজ হযরত আবদুর রহমান হানাফী। (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)
*সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ৪১; লেখকঃ বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী। (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)
হক তা'আলার মিছাল হয় না, মিছাল হতে পারেঃ হক সুবহানুহু ওয়া তাআ'লা 'মিছাল' বা, সাদৃশ্য থেকে পবিত্র। যেমন, আল্লাহর বাণীঃ 'তাঁর সদৃশ কিছুই নাই।' (সূরা শূরা, আয়াত ১১)
কিন্তু, উলামারা 'মিছাল' বা, 'মাছাল' কে জায়েয বলেছেন। যেমন, আল্লাহর বাণীঃ 'আল্লাহ্ তাআ'লার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উপমা আছে, অথবা, আল্লাহর জন্যই তো সর্বোকৃষ্ট শান বা, মর্যাদা'। (সূরা নাহল, আয়াত ৬০)
সুলুকের পথে ভ্রমণকারীগণ এবং কাশফের অধিকারীরা উপমার দ্বারাই শান্তিপ্রাপ্ত হন এবং ধ্যানের মাধ্যমে তৃপ্তি লাভ করেন। তারা বর্ণনাহীনকে বর্ণনাযুক্ত দেখতে থাকেন- যাতে ওয়াজেবকে সম্ভাবনার আকৃতিতে পান। বেচারা সালেক, দৃষ্টান্তকে দৃষ্টান্তের মালিকের অনুরূপ মনে করে এবং সুরত বা, আকৃতিকে- আকৃতির মালিকের অনুরূপ ধারণা করে থাকে। এর কারণ এই যে, সালেক হক্ সুবহানুহু ওয়া তাআ'লার পরিবেষ্টনকারী আকৃতিকে, সমস্ত বস্তুর মধ্যে পরিদর্শন করে এবং ঐ পরিবেষ্টনের উপমাকে সমস্ত দুনিয়ার মধ্যে মুশাহিদা করে এবং সে মনে করে যে, যা কিছু দৃষ্টিগোচর হয়, তার সবই হক সুবহা-নুহুর আবেষ্টনীর হাকীকত। কিন্তু, প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। কেননা, হক তাআ'লার বেষ্টনী তো দৃষ্টান্ত ও তুলনাহীন এবং তিনি শুহুদ বা, দর্শন এবং 'প্রকাশ পাওয়া' অবস্থা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। আমরা এই কথার উপর ঈমান রাখি যে, আল্লাহ্ তাআ'লা সব বস্তুর পরিবেষ্টনকারী; কিন্তু, আমরা তাঁর এই পরিবেষ্টনের স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত নই? আমরা যা কিছু জানি, তা হলো এই পরিবেষ্টনের তুল্য অবস্থা। হক্ তাআ'লার কুরব বা, নৈকট্য এবং মা'য়ীআত বা, সঙ্গতাকে এর উপর কিয়াস বা, ধারণা করতে হবে। যা কিছু কাশফ ও মুশাহিদার মধ্যে আসে, তা তো আনুরূপ্য মাত্র, হাকীকত বা, আসলরূপ নয়। বরং, এই সমস্ত কথার বাস্তবরূপও অজ্ঞাত। আমরা এর উপর ঈমান রাখি যে, হক তাআ'লা আমাদের নিকটে এবং সঙ্গে; কিন্তু, আমরা এটা জানি না যে, এই নৈকট্য ও সঙ্গতার হাকীকত কি? এ সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ আছেঃ 'আমাদের রব হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় প্রকাশিত হবেন।' এই বাক্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিছালী আকৃতি বর্ণনা করেছেন। কারণ, পূর্ণ রেজা (সন্তুষ্টি) অর্জনের দৃষ্টান্ত হাস্যোজ্জ্বল আকৃতিই হওয়া উচিত। একইভাবে হাত, চেহারা, পা, অঙ্গুলী ইত্যাদির দৃষ্টান্তও অনুমান করা যেতে পারে।
[মাবদা ওয়া মা'আদ, মিনহা ৬০, পৃষ্ঠা ৯৮]
সতর্কবাণীঃ হাল, জযবা, ইলম ও মা'রেফাতসমূহ বর্ণনার কালে, যদি এই লেখকের (হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির) বক্তব্যের মধ্যে কোনোরূপ বৈসাদৃশ্য ও বৈপরিত্য পরিলক্ষিত হয়, তবে তা সময়ের বিভিন্নতা এবং হাল ও অবস্থার পার্থক্যের কারণে হয়েছে মনে করতে হবে। কেননা, প্রত্যেক সময়ের হাল ও জযবাসমূহ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক অবস্থার জ্ঞান ও মা'রেফাতসমূহ স্বতন্ত্র হয়। সুতরাং, প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো বৈসাদৃশ্য ও বৈপরিত্য নয়। এর উদাহরণ শরীয়তের হুকুম-আহকামের মতো। যেমন, তা মানসুখ বা, পরিবর্তনের পর, বিপরীত হুকুম বলে মনে হয়। কিন্তু, যখন সময় ও অবস্থার বিভিন্নতাকে সম্মুখে রাখা হয়, তখন এ মতানৈক্য ও বৈপরিত্য আর থাকে না। এর মধ্যে আল্লাহ্ সুবহা-নুহু ওয়া তাআ'লার হিকমত এবং কল্যাণ নিহিত আছে। কাজেই, তোমরা কেউই সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
আমাদের নেতা ও সরদার হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং উনার পরিবার-পরিজনদের উপর দরূদ, সালাম ও বরকত নাযিল হোক।
- মাবদা ওয়া মা'আদ (মিনহা একষট্টি, পৃষ্ঠা ৯৯)
0 Comments